পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৩

A.R.Rahman ....

সংগীত পরিচালক ও গায়ক এ আর রহমানের জন্ম ভারতের চেন্নাইয়ে, ১৯৬৬ সালের ৬ জানুয়ারি। দুবার অস্কার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০১২ সালের মে মাসে মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এ বক্তব্য দেন এই তারকা সংগীতজ্ঞ। সূত্র: ওয়েবসাইট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার আজ থেকে ২৪ বছর আগে কখনো ভাবতে পারিনি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে দেখা করার আমন্ত্রণ পাব। মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এখানকার শিক্ষার্থীদের সামনে আমার কাজ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া তো দূরের কথা, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়াটাই ছিল অবাস্তব কল্পনা। কিন্তু আজ আমি মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি নিচ্ছি। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় ১০ বছরের। এখানকার অনেক শিক্ষার্থী, যারা সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হওয়া সত্ত্বেও আমার সুরকে তাদের জীবনের অংশ করে নিয়েছে। আমি তাদের দেখে সত্যিই অভিভূত। এখানকার অভিজ্ঞতাই আমাকে ভারতে একটি ‘ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল অবজারভেটরি’ তৈরি করার সাহস দিয়েছে। আজ এখানে এসে আমার টুকরো টুকরো অনেক কথা মনে পড়ছে। প্রথমত, ভ্রমণ থেকে শিক্ষা লাভ করা। মনকে সব সময় বলি, পথ চলতে চলতে যা-ই পাওয়া যায়, তাকে উদার চোখে দেখতে হবে, গ্রহণ করতে হবে। কোথাও যাওয়ার আগেই তার সবকিছু নিয়ে আমরা কম-বেশি একটা ধারণা তৈরি করে নিই। কিন্তু আমাদের এটা বুঝতে হবে যে প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, চিন্তাচেতনা ও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। কোনো একটা স্থানের অনেক অন্তর্নিহিত রহস্য থাকে, যা আমরা সশরীরে, স্বচক্ষে, খোলা মনে পর্যবেক্ষণ না করলে কখনো ধরা দেয় না। এই সত্যগুলোকে জানতে হলে নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত, কখনো তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া। এ ব্যাপারটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যখন আমরা কোনো মানুষের বেলায় চিন্তা করি। সব গল্পের পেছনেই একটি ভিন্ন গল্প থাকে, যেমন একটি মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ সম্পূর্ণ ভিন্ন হতেই পারে। মানুষের বেলায়ও ঠিক তা-ই। আমাদের সব সময় মানুষের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে খুঁজে দেখতে হবে এবং তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। এমনকি কোনো স্থান, প্রতিষ্ঠান কিংবা শিল্পকলার ব্যাপারেও এই নীতি প্রযোজ্য। আমরা যদি বাইরের দৃশ্যমান রূপটাকেই চূড়ান্ত বলে ধরে না নিয়ে একটু গভীরভাবে মনের চোখ দিয়ে দেখতে শিখি, একটু ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, তা হলে আমার বিশ্বাস আমাদের অর্ধেক সমস্যারই কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। তৃতীয়ত, যখন জীবনে কোনো সংকটময় মুহূর্ত আসবে, তখন মনকে শান্ত করে ফেলতে হবে, গতি কমিয়ে আনতে হবে। সংকট সমাধানে যে পদক্ষেপই নাও না কেন, তা দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করতে হবে। শুধু একটা কথা মনে রাখবে, কখনো রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আশা কোরো না। তোমার পুরস্কার ঠিক সময়েই তোমার হাতে পৌঁছাবে। যদি উপযুক্ত সময়ের আগেই তুমি তোমার সব কাজের মূল্যায়ন পেয়ে যাও, তা হলে সেই মূল্যায়ন আর পুরস্কার একটা সময় তোমার পতনের শুরু করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। চতুর্থত, যারা তোমার চেয়ে কম ভাগ্যবান, জীবন যাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসেনি, সেই দরিদ্রদের জন্য, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য সব সময় কিছু করার চেষ্টা করো। তাদের থেকে আলাদা হয়ে যেয়ো না কিংবা তাদের অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করো না। চিন্তা করো, কীভাবে তাদের জীবন আরেকটু সুন্দর করা যায়, কীভাবে তাদের টেনে তোলা যায়। অন্যকে সাহায্য করার জন্য তোমার ক্ষুদ্র এই প্রচেষ্টাগুলো আসলে অনেক মহৎ, অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চমত, সত্য ও সততা—এই গুণগুলোকে অর্জন করা যতটা অসাধ্য বলে মনে করা হয়, তেমনটা মোটেও নয়। তুমি যদি সত্যিই চাও, তা হলে এটা পানির মতোই সহজ ও সরল একটা ব্যাপার। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিংবা জীবনের নানা চাহিদা প্রায়ই সততার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ দুটোর মধ্যে একটা যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়তো তোমার জীবনের অনেকটা সময়ই পার হয়ে যাবে। কিন্তু বিশ্বাস করো, এই ভারসাম্য এতটাই দরকারি আর মূল্যবান যে এর জন্য আজীবন চেষ্টা করার মধ্যেও কোনো গ্লানি নেই। এই ব্যাপারটিকে ভারতে আমরা বলি, ‘সত্যমেভ জয়তে’ অর্থাৎ সত্যের জয় হবেই। আমি কিছু মানুষকে আজ আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই, আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে যাঁদের অবদান অপরিসীম। আমার বাবা, মা ও একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, যিনি আমাকে জীবনের প্রথম বড় সুযোগটি দিয়েছিলেন, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরা, সমগ্র ভারতবাসী যারা আমাকে ও আমার সুরকে কোনো দ্বিধা বা বৈষম্য ছাড়াই পরম মমতায় বরণ করে নিয়েছেন। আজ আমি একই গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছি হলিউডে এসে, আমি সত্যিই সম্মানিত। সংগীত কোনো ব্যক্তি, সমাজ কিংবা জাতির নয়। সুর সবার জন্য। আমি যখন ‘বাখ’ শুনতাম, আমি কখনো ভাবিনি, তার জাতি কী, ধর্মই বা কী। সংগীতের বিশুদ্ধতাই এখানে একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। ২৪ বছর ধরে আমি সেই বিশুদ্ধ সুরের জগতে ডুবে আছি। সেই দর্শনগুলোকে বোঝার চেষ্টা করছি, যা সুরের ভাষার জন্ম দিয়েছে। আজকের এই সমাবর্তন তোমাদের জীবনের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি নয়, বরং একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এ দিনটি একটি নতুন গল্পের শুরু, যা হয়তো তোমাদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে। আমি জানি, তোমরা অত্যন্ত মেধাবী। তবে এই যাত্রায় মেধার চেয়েও একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তোমাদের অনেক বেশি সহায়তা করবে। আর তা হলো, ঠোঁটের কোণে একটি মধুর হাসি। হাসতে শেখো, বাঁচতে শেখো। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন