পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১২

নিজেকে কখনো অবমূল্যায়ন কোরো না







যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে, ৪ আগস্ট ১৯৬১। সম্প্রতি ৬ নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১২ সালের ১৪ মে বার্নার্ড কলেজের সমাবর্তনে তিনি এই বক্তৃতা দেন।

উপস্থিত সবাইকে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ! অভিনন্দন ২০১২ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা! তোমাদের চারপাশের সবাই আজ তোমাদের নিয়ে গর্বিত। তোমাদের বাবা-মা, পরিবার, শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব, সবাইকে অভিনন্দন!
আমি গ্র্যাজুয়েশন করি ১৯৮৩ সালে। তখন আমাদের আইপড ছিল না, ছিল শুধু ওয়াকম্যান। টাইমস স্কয়ারও আজকের মতো ছিল না। সেসব এখন ইতিহাস। আমি জানি, সমাবর্তন বক্তা ইতিহাসের বুলি কপচানো শুরু করলে তার মতো বিরক্তিকর ব্যাপার আর হয় না!

তোমাদের জন্য আমার প্রথম উপদেশ, কোনো কাজই দায়সারাভাবে করবে না। কাজ যখন করবেই, দারুণ কিছু একটা করবে। নিজের স্বপ্নের জন্য সংগ্রাম করবে। যদি বড় কিছু হতে চাও, তার জন্য কাজও সেভাবেই করতে হবে। তোমাদের সামনে যে অবারিত সুযোগ আছে, সেগুলোকে ঠিক সময়ে কাজে লাগাতে হবে। শুধু নিজেদের উন্নতির জন্য নয়, যারা তোমাদের সমান সুযোগ এখনো পায়নি, তাদের উন্নয়নের জন্য তোমাদের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
তোমার ভবিষ্যৎ কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে অন্যের কথায় কান দিয়ো না। জীবন তোমার নিজের হাতে। কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত—নিজেই বুঝে নিতে শেখো। সব সময় নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হবে। তোমার সমস্যা তোমাকেই সবার সামনে তুলে ধরতে হবে, রাস্তায় তোমাকেই নামতে হবে। শুধু বসে বসে কী হচ্ছে দেখলে চলবে না।

যা ঠিক, তাকে জোর গলায় বলতে দ্বিধা কোরো না। অন্য কেউ বলবে, সেই আশায় বসেও থেকো না। হয়তো অন্যরাও একই কথা ভাবছে, হয়তো সবাই তোমার অপেক্ষায় বসে আছে, কে জানে! আর তাই তোমাদের জন্য আমার দ্বিতীয় উপদেশ, নিজেকে কখনো অবমূল্যায়ন কোরো না। তুমি নিজেই সম্ভাবনার এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে উঠতে পারো, তখন তোমার সাফল্য আর দশজনকে স্বপ্ন দেখাতে উৎসাহিত করবে। নিজের এই বিপুল সম্ভাবনাকে কখনো ছোট করে দেখো না। তোমাদের আমি এক নারীর গল্প বলতে পারি। তার পরিবার এ দেশে অভিবাসী হয়ে এসেছিল। স্কুলে থাকতে তাকে বলা হতো, তার মাথায় যে বুদ্ধি, তাতে কলেজে ভর্তি না হওয়াই শ্রেয়। তার শিক্ষক উপদেশ দিয়েছিলেন, স্কুলের পড়ার পাট চুকিয়ে কোনো একটা কাজে লেগে যেতে। কিন্তু মেয়েটি ছিল ভীষণ জেদি, সে শিক্ষকের কথা কানে তোলেনি। সে কলেজে ভর্তি হলো। একসময় মাস্টার্স ডিগ্রিও লাভ করল। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচল করল, জিতে গেল। প্রাদেশিক পদের জন্য লড়াই করল, সেখানেও জিতল। কংগ্রেস নির্বাচনে অংশ নিল, সেখানেও না জিতে ছাড়ল না। শেষ পর্যন্ত হিলডা সলিস পড়াশোনার পাট চুকিয়েছে, কাজও করছে। তবে যেখানে-সেখানে নয়, সে আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে!

ভেবে দেখো, আজ যখন কোনো ছোট্ট লাতিন মেয়ে দেখছে তার মতোই আরেকজন মেয়ে দেশের মন্ত্রী হতে পেরেছে, তখন সে কতটা উৎসাহিত বোধ করে! একজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী যখন দেখে তার মতো কেউ জাতিসংঘের দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে, তখন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার স্বপ্ন কতটা বদলে যায়! তুমি জানোও না, নিজের অজান্তেই এই পৃথিবীতে তুমি কত কিছু বদলে দিতে পারো। নিজেকে কখনো ক্ষুদ্র ভেবো না, নিজের সম্ভাবনার অমর্যাদা কোরো না। নিজেকে দশজনের জন্য রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করো। তুমি আজ যেখানে এসেছ, সেখানে আসতে অন্যদের উৎসাহিত করো, সহযোগিতা করো। একজন মেয়ে যত দিন না নিজেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামার কিংবা সামরিক কমান্ডার হিসেবে কল্পনা করবে না, তত দিন সে তা হতেও পারবে না। আশপাশের নারীরা যত দিন তাকে না জানাবে যে বাহ্যিক সৌন্দর্য কিংবা ফ্যাশন ছাড়াও চিন্তাভাবনার অনেক কিছু আছে—নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হবে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, নেতৃত্ব দিতে হবে—তত দিন পর্যন্ত সে হয়তো ভাববে সৌন্দর্যের মধ্যেই তার জগৎ সীমাবদ্ধ। তোমরা নিজেদের গুরুত্ব অনুধাবন করো এবং নিজেদের শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাও।

আমার শেষ উপদেশ হলো, ধৈর্য ধরো। শুনতে খুবই সহজ আর সাদামাটা মনে হচ্ছে, কিন্তু এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো ভালো জিনিসই সহজে পাওয়া যায় না। এমন কোনো সফল মানুষ পাবে না, যে ব্যর্থতাকে এড়িয়ে যেতে পেরেছে। বরং তার উল্টোটাই হতে দেখা যায় সব সময়। তারা মারাত্মক সব ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে। তারা ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। তারা কখনো হাল ছেড়ে দেয় না।
তোমাদের বয়সে আমার পকেটে টাকা বলতে গেলে ছিলই না, সামনে এত সুযোগও ছিল না। এই বিশাল পৃথিবীতে আমি নিজের স্থান খুঁজে ফিরছিলাম। আমি চাইতাম বড় কিছু করতে, চারপাশকে বদলে দিতে। কিন্তু কীভাবে তা করব, এ নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না আমার। গ্র্যাজুয়েশনের পর আমাকে এই নিউইয়র্কে অনেক ছোটখাটো কাজ করে জীবন চালাতে হয়েছে। তবু আমি ভুলে যাইনি আসলে কী করতে চেয়েছিলাম।

অসীম ধৈর্য আমার জন্মগত কোনো গুণ নয়। আমি ধৈর্য ধরতে শিখেছি। শৈশবে যে নারীরা আমাকে লালনপালন করেছিলেন, তাঁদের দেখে আমি শিখেছি ধৈর্য কী জিনিস। আমার মা কী সংগ্রাম করে একই সঙ্গে পড়াশোনা, চাকরি আর আমাকে সামলেছেন, তা আমি দেখেছি। অসম্ভব অর্থকষ্ট, তার ওপর ভেঙে যাওয়া সংসার। কিন্তু তিনি কখনো হাল ছাড়েননি। খুব ভোরে মা আমাকে ডেকে তুলতেন ইংরেজি পড়ার জন্য। আমার বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে যেত। অভিযোগ করলে মা বলতেন, ‘এটা আমার জন্যও পিকনিক নয়, গাধা কোথাকার!’ পরে আমি আমার নানির কাছে বেড়ে উঠি। তিনি হাইস্কুলের পর আর পড়তে পারেননি। একটা স্থানীয় ব্যাংকে কাজ করতেন নানি। যেসব পুরুষকে তিনি একসময় প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, তাঁর চোখের সামনে তারা পদোন্নতি পেয়ে ওপরে উঠে যেত। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি। নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়ে কাজ করে গেছেন। একসময় তিনি সেই ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। না, তিনিও হার মানেননি।
পরে আমার সঙ্গে এক নারীর দেখা হয়, যাঁর দায়িত্ব ছিল আমার চাকরির ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া। তিনি আমাকে এমন পরামর্শ দিয়েছিলেন যে শেষ পর্যন্ত আমি তাঁকে বিয়েই করে ফেলি! বিয়ের পর ক্যারিয়ার আর সংসার একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে মিশেল ও আমি দুজনেই দারুণ হিমশিম খেয়েছি। আমাদের ধৈর্য ছিল বলেই সেই কঠিন সময়গুলোতে সংসার টিকিয়ে রাখতে পেরেছি। মিশেলের বাবা-মা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। তাঁদের আদর্শের গুণেই আজ মিশেল এত কিছু সামলে নিতে পেরেছে, আমার জীবনের ওঠানামার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।
এই মানুষেরাই আমার সব অনুপ্রেরণার উৎস। যাদের কথা কখনো খবরে আসে না, যারা দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে, কেউ চেনেও না তাদের। তারা শুধু নিজের দায়িত্ব নিঃশব্দে পালন করে যায়, বিপদের সামনে শক্ত হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, কোনো কিছুতেই তারা হার মানে না। আমি আজ তাদের জন্যই এতদূর আসতে পেরেছি। তারা নিজেরা পৃথিবী বদলানোর জন্য উঠেপড়ে লাগেনি, কিন্তু তারা আছে বলেই পৃথিবীটা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে, যাবে।

মনে রেখো, এই পৃথিবীতে নিজের চিহ্ন রেখে যাওয়া সোজা নয়। এর জন্য ধৈর্য ধরতে হয়, প্রতিজ্ঞা থাকতে হয়। হেসেখেলে সফল হওয়া যায় না। সাফল্যের জন্য প্রতি মুহূর্তে ব্যর্থতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। তুমি যদি সংগ্রাম করে নিজের জায়গা করে নিতে পিছপা না হও, দশজনের সামনে নিজেকে দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারো আর যত বাধা আসুক না কেন হাল ছেড়ে না দিয়ে লেগে থাকতে জানো, তাহলে আমি নিশ্চিত বলতে পারি, শুধু তুমিই সফল হবে না, তোমাকে দেখে আরও অনেকে সফল হতে শিখবে। তোমাদের সাফল্যে গোটা জাতি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন।
সূত্র: ইন্টারনেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন